২০২০ সালে দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) রাজধানীর মহাখালীতে একটি ডেডিকেটেড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। এটি ‘মহাখালী কোভিড হাসপাতাল’ নামে পরিচিতি পায়। হাজারের বেশি শয্যার এই হাসপাতালটি করোনার প্রকোপের সময় কাজে লাগলেও এখন পড়ে আছে অনেকটা অযত্ন-অবহেলায়। হাসপাতালটিতে কিছু রোগী থাকলেও ফাঁকা পড়ে আছে বেশির ভাগ সিট। নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। রয়েছে নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার অভিযোগও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে. হাসপাতালটিতে রয়েছে আইসিইউ সুবিধাসহ ২১২টি শয্যা, ১১২টি আইসিইউ এবং ১০০টি এইচডিইউ, বিশেষ সুবিধাসহ ২৫০টি শয্যা, জরুরি বিভাগে ৫০টি শয্যা ও ডায়ালাইসিস সুবিধাসহ চারটি শয্যাসহ হাজারের বেশি শয্যা। আর আইসিইউ বেডগুলোর জন্য রয়েছে ৯টি ওয়ার্ড। হাসপাতালটিতে রাখা হয় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা। দেশে যখন করোনাভাইরাসের প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করে তখন এই হাসপাতালটির কদর ছিল তুঙ্গে। কিন্তু মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর থেকে অনেকটা অভিভাবকহীন অবস্থায় পড়ে আছে। যেন দেখার কেউ নেই। হাসপাতালটির পদে পদে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে। সরেজমিনে ঘুরেও প্রমাণ মিলেছে এসব অভিযোগের।
যন্ত্রপাতি সবকিছুই প্রস্তুত আছে। যখন ডেঙ্গু আর করোনা ছিল না, তখন আমরা জেনারেল রোগীদেরও চিকিৎসা দিয়েছি। সুতরাং আইসিইউ সবসময় চলমান।
একদিকে আইসিইউ সংকটে রাজধানীতে প্রায়ই রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে, অন্যদিকে এই হাসপাতালটিতে খালি পড়ে আছে শতাধিক আইসিইউ বেড। তীব্র তাপদাহ মোকাবিলায় গত মে মাসে হাসপাতালটিতে চালু করা হয় ২৫ শয্যাবিশিষ্ট হিটস্ট্রোক সেন্টার। গত বুধবার হাসপাতালটিতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় কোভিড পরীক্ষা করার লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন রোগীর স্বজনরা। দেখা মেলে কয়েকজন চিকিৎসক আর নার্সের। কোনো রুমে দেখা মেলেনি চিকিৎসকদের। হাসপাতালটির দ্বিতীয় তলায় রয়েছে জরুরি নারী ও পুরুষ ওয়ার্ড। দ্বিতীয় তলার জরুরি মেডিসিন মহিলা ওয়ার্ডে নেই কোনো রোগী, পড়ে আছে ২২টি বেড। জরুরি মেডিসিন ওয়ার্ডের (পুরুষ) বেডের তিন ভাগের দুই ভাগই পড়ে আছে। জ্বর, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত ১৫ শিশু রোগী ভর্তি আছে। তৃতীয় তলার জেনারেল মহিলা ওয়ার্ডে প্রায় ৪০ জন রোগী ভর্তি আছেন। স্টিকারে সাঁটানো ডায়রিয়া কর্নারটি বন্ধ দেখা যায়। ডিউটি সুপারভাইজার নার্স (ফিমেল) রুম তালাবদ্ধ দেখা যায়, যদিও ভেতরে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। পোস্ট কোভিড-১৯ ক্লিনিক রুমটিও তালাবদ্ধ দেখা যায়। চতুর্থ তলায় পড়ে প্রায় ৫০টি বেড, নেই কোনো রোগী, ফ্যান ঝুলানো থাকলেও নেই কোনো লাইট, মনে হবে ভুতুড়ে স্থান। এখানে অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে সরকারি সম্পত্তি। চতুর্থ তলার চিকিৎসক ও নার্সদের রুমগুলো রয়েছে তালাবদ্ধ, কোনো কোনো রুমে এপ্রোন ঝুলানো আছে, আর চলছে ফ্যান। চতুর্থ তলায় দেখা মেলেনি কোনো চিকিৎসক বা নার্সের। তবে একজন আনসার সদস্যকে দেখা গেছে। পঞ্চম তলার পরিবেশ আরও ভুতুড়ে। এখানে সব রুমই তালাবদ্ধ, জ্বলেনি কোনো লাইট। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে বেড। লিফট দিয়ে ঢুকলে দেখা যাবে, পোস্টারে সাঁটানো প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র, তবে দেখা মেলেনি কোনো চিকিৎসক বা নার্সের। অলস সময় পার করছেন একজন আনসার সদস্য। তিনি বসে-হেঁটে সময় কাটাচ্ছেন। ষষ্ঠ তলায় রয়েছে ৯টি আইসিইউ ওয়ার্ড। প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ১৫টি করে বেড। আইসিইউ-২ ওয়ার্ডে বেড পড়ে আছে, নেই কোনো রোগী। দেখে মনে হবে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার হচ্ছে না। আর আইসিইউ ওয়ার্ড-১ এ কোনো বেড নেই, ফাঁকা পড়ে আছে জায়গা। নেই কোনো লাইট, ফ্যান। আইসিইউ-৩-এ করোনার রোগী ভর্তি দেখা গেছে। আইসিইউ-৫ এ ২৬ জন রোগী আছেন। আইসিইউ-৪ ওয়ার্ডে ১০ জন জেনারেল রোগী ভর্তি আছেন, অনেক বেডই ফাঁকা পড়ে আছে।
নার্সিং ইনচার্জ তাজুন নাহার বলেন, এই ওয়ার্ডে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগী ভর্তি রয়েছেন। এরমধ্যে ডেঙ্গু আর চিকনগুনিয়ার রোগী বেশি। ষষ্ঠ তলার আইসিইউ-৬-এ কোনো রোগীর দেখা মেলেনি, নেই চিকিৎসক বা নার্সও। পড়ে আছে যন্ত্রপাতি। আইসিইউ-৭, ৮, ৯ ওয়ার্ডও ফাঁকা পড়ে আছে। তবে আইসিইউ-৮-এর বেডে একজন স্টাফ শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৭-৮ মাস ধরে এখানকার আইসিইউ বন্ধ আছে। নষ্ট হয়ে আছে এসি। নতুন করে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ায় আবার এটি মেরামতের প্রস্তুতি চলছে। ষষ্ঠ তলার টেলি কনফারেন্স রুমটিও তালাবদ্ধ, বাহির থেকে দেখা যাচ্ছে টেবিলে ধুলা-ময়লা পড়ে আছে। শুধু এটি নয়, আইসিইউ অ্যান্ড এইচডিইউ ডক্টরস রুমটিও স্যালাইনের পাইপে ভরা, যা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ভেতরে নেই কোনো চিকিৎসক। ষষ্ঠ তলার অ্যানেসথেসিয়া ইনচার্জের রুমসহ অনেক রুমই তালাবদ্ধ। এমনকি স্টিকারে সাঁটানো আইসিইউ নিয়ন্ত্রণ কক্ষটিও তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। গত ১৭ জুন রাজধানীর বাড্ডা থেকে জ্বরে আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে ডিএনসিসি হাসপাতালে আসেন রাজমিস্ত্রী রেজাউল করিম (ছদ্মনাম)। পরে তার মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। সঙ্গে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়াসহ বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন। জানতে চাইলে রেজাউল করিম বলেন, আমার মেয়েকে যে কয়েকটি পরীক্ষা দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে চিকনগুনিয়াসহ কয়েকটি পরীক্ষা এই হাসপাতালে করতে পারিনি। অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে করে নিয়ে এসেছি, তাতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আরও কয়েক দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। তিনি হাসপাতালের চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও এখানকার নানা অব্যবস্থাপনায় অসন্তুষ্ট। তিনি বলেন, এই হাসপাতালের ওয়াশরুমের পরিবেশ একেবারে খারাপ। হাইকমোড নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। আর পুরো ওয়াশরুমে জমে আছে ময়লা পানি। খুবই নোংরা পরিবেশ।
জানা গেছে, বর্তমানে হাসপাতালটিতে শতাধিক রোগী ভর্তি আছেন। এখানে ডেঙ্গু ও করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও নেই চিকনগুনিয়া ও ব্লাডের কোলেস্টেরল পরীক্ষার ব্যবস্থা। আর কতজন চিকিৎসক ও নার্স কর্মরত আছেন তা জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কেউ।
হাসপাতালটির পরিচালক কর্নেল ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, কোভিড ডেডিকেটেট হাসপাতালটি সবসময় প্রস্তুত আছে। প্রয়োজনে এক হাজার ৫৪ জনের বেডে রূপান্তরের সক্ষমতা রয়েছে। একপ্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইসিইউ সবসময় অপারেশনাল ছিল। এগুলো আমরা ব্যবহার করেছি। আইসিইউ হয়ত আমরা চালু করিনি। যন্ত্রপাতি সবকিছুই প্রস্তুত আছে। যখন ডেঙ্গু আর করোনা ছিল না, তখন আমরা জেনারেল রোগীদেরও চিকিৎসা দিয়েছি। সুতরাং আইসিইউ সবসময় চলমান।
ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, করোনা আর ডেঙ্গু ছাড়াও আমরা চিকিৎসা দিই। মেডিসিন, গাইনি, কার্ডিওলজিসহ কয়েকটি রোগের চিকিৎসা দিয়ে থাকি। সার্বিক বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগের পরিচালক ডা. মঈনুল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কোভিড হাসপাতালটি ঘুরে মিলল অনিয়ম অব্যবস্থাপনার নানা চিত্র
- আপলোড সময় : ২১-০৬-২০২৫ ০৭:১০:০২ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২১-০৬-২০২৫ ০৭:১০:০২ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ